জুলাই ৩০, ২০২২
মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিকের সংবাদ দর্শন আমাদের চাই পলাশ আহসান
১৯৭১ এর ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয়ের পরদিন ১৭ই ডিসেম্বর কোন পত্রিকা প্রকাশ হয়নি। হয়েছিল ১৮ই ডিসেম্বর। বিজয়ের যত খবর ওইদিনই প্রকাশ হয়েছিল। কোন পত্রিকায় কী শিরনাম ছাপা হয়েছিল এই লেখা শুরুর আগে সেটা জেনে নেয়া দরকার। কারণ ওইদিন আমাদের সাংবাদিকতা কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের নিয়ামক হিসাবে কাজ করেছিল, তা চূড়ান্তভাবে প্রকাশ হয়েছিল। দৈনিক পাকিস্তান এর মাস্ট হেড থেকে পাকিস্তান ক্রশ চিহ্ন দিয়ে কেটে তার ওপরে বাংলা লিখে দৈনিক বাংলা হিসাবে পত্রিকা প্রকাশ হয়েছিল। এই এক ক্রশ চিহ্নের মধ্যেই ছিল পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের সহজ বার্তা। দৈনিক বাংলার প্রধান শিরনাম ছিল ‘জয় বাংলার জয়’ আজাদের শিরনাম ছিল ‘বীরের রক্ত স্রোত আর মায়ের অশ্রুধারা বৃথা যায় নাই’ বাংলাদেশ রাহুমুক্ত। পূর্বদেশ তাদের মাস্ট হেড পত্রিকার মাঝ বরাবর নামিয়ে এনেছিল। ওপরে শিরনাম দিয়েছিল ‘হে বীর হে নির্ভয় তোমারই হলো জয়, জয় বাংলা বাংলার জয়। দৈনিক ইত্তেফাক শিরনাম ছেপেছিল ‘সোনার বাংলায় মানব ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকান্ড। এবার আসছি একটু পেছনের গল্পে। আমাদের তথা বাংলাদেশের পত্রিকা প্রকাশের কাছে। ১৯৭১ সালে ১৬ই ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের আগ পর্যন্ত পত্রিকার সংখ্যা ছিল ১০টি। এর বেশিরভাগই কাজ করছিল বাঙালী জাতীয়তাবাদ তথা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। বলা বাহুল্য তারা স্বাধীনতার পক্ষের রাজনীতি প্রচার করছিলেন। সংগ্রামের মত আর যে দু’একটি পত্রিকা বিরোধী মত প্রচার করছিল, তাদের উদ্দেশ্য ছিল দেশ স্বাধীন না হওয়ার রাজনীতি প্রচার। কাজে কাজেই আমরা বলতেই পারি বিশ্ব সাংবাদিকতার ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের সাংবাদিকতার শুরুটাও ছিল নিখাদ রাজনৈতিক। আমার ব্যক্তিগত মত একটু ভিন্ন। আমি বলতে চাইনা সাংবাদিকতা চোখ বন্ধ করে মুক্তি যুদ্ধের পক্ষে ছিল। আসলে সাংবাদিকতা সাংবাদিকতার পক্ষেই হেঁটেছে। অর্থাৎ সত্যের পক্ষে থেকেছে। বাঙালির দীর্ঘ যে বঞ্চনা তা কোন বানানো ব্যাপার ছিল না। সেই সত্য মানুষের সামনে তুলে ধরেছে। মুক্তিযুদ্ধ সৃষ্টির যে গল্প শুনি তাতে তো আমার মনে হয় ভয়ে সেসময়ের সংবাদপত্র অনেক কিছু বলতে পারেনি। অনেক কিছু বলেছে রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে। ইতিহাস বলছে সত্য চেপে রাখতে পত্রিকা অফিসে আগুন দেয়া হয়েছে। এর মধ্যেও সাংবাদিকরা সত্য বলার কাজটি করেছেন। দেশে বিদেশে মানুষ জেনেছে পাকিস্তানিদের ধর্মের নামে মিথ্যাচারের কথা। এই সত্য জানতেও মানুষকে সেদিন নিজেকে গোপন করতে হতো। পত্রিকা পড়েছে লুকিয়ে। স্বাধীন বাংলা বেতার শুনতো রেডিও কানে চেপে। জোরে রেডিও বাজালে বাড়ির পাশের আলবদর পাকিস্তানি ক্যাম্পে খবর দিয়েছে। তারা এসে বহু বাড়ির বেতার যন্ত্র নিয়ে গেছে অথবা অকেজো করে গেছে। তারা রেডিও শোনা এবং শোনানোর অপরাধে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যাও করেছে অনেক যায়গায়। যাই হোক। দেশ স্বাধীনের পর বলতে আর কোন দ্বীধা রইলো না বেশিরভাগ সাংবাদিকের সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল। আরো একবার সাংবাদিকের গর্ব মাথা উঁচু করে দাঁড়ালো। পরিস্কার করে বলা হলো বেশিরভাগ গণমাধ্যম যেদিকে সত্য সেদিকে। এই সুযোগে বলে রাখি আজও সেই সত্য বহাল আছে। বাংলাদেশের গণমাধ্যম কর্মীরা সবাই এক সঙ্গে কোন গণবিরোধী সিদ্ধান্ত নেননি। বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে, মুক্তিযুদ্ধের আগে যারা সাংবাদিকতা করতে এসেছেন প্রত্যেকেরই একটা শক্ত রাজনৈতিক ভিত্তি থেকে এসেছেন। তাঁরা সব এমন মানুষ যে ধমক দিলেই সত্য বলা বন্ধ করবেন না। তাই হাজার জোরেও তাদের জনতার বিপক্ষে দাঁড় করানো যায়নি। দীর্ঘদিন সেই পরম্পরা আমাদের সাংবাদিকতায় ছিল। মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীনভাবে কাজ করা সংবাদ কর্মীদের অনেককে সুযোগ দেয়ার পরেও সাংবাদিকতা ছাড়লেন না। তবে বেশিরভাগই সরাসরি রাজনীতি ছেড়ে দিলেন। অথচ তারা প্রায় সবাই ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী। চাইলেই পারতেন নিরাপদ চকচকে জীবন যাপনে যেতে। কিন্তু বেছে নিলেন দিনের পর দিন বেতন না পাওয়ার পথ। হাজারটা অনিশ্চয়তার উচ্চস্বরের হাসিতে মাতিয়ে রাখলেন প্রতিটি বার্তাকক্ষ, সঙ্গে প্রেসক্লাব। এই সময়ে তাঁদের হাত ধরে সাংবাদিকতায় এলেন তাঁদরেই সমমনা কিছু ছেলে মেয়। তখনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতা পড়ে সাংবাদিকতা করতে আসা শুরু হয়নি। এই জ্যেষ্ঠদের অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগ করার পক্ষে জোর দিলেন। সহযোগীও হলেন কেউ কেউ। আবার বার্তাকক্ষেও সক্রিয় থাকলেন। তাঁদের হাত ধরেই এগোলো আমাদের সাংবাদিকতা। কোন কোন বিশ্লেষক এই সময় পর্যন্ত আমাদের সাংবাদিকতার রাজনৈতিক পর্ব বলে চিহ্নিত করেন। তাঁরা এর সময় নির্ধারণ করেন ১৯৭১ থেকে ১৯৯০-৯২ পর্যন্ত। বিশ্লেষকরা আজ পর্যন্ত সাংবাদিকতার সময়ে আরো দু’টি ভাগ বসিয়েছেন। এর একটিকে বলেন শুধু নিরেট তথ্য নির্ভর সাংবাদিকত। আরেকটি ভাগকে বলেন কর্পোরেট সাংবাদিকতা। বিশ্লেষণে বের হয়ে আসে রাজনৈতিক পর্যায় থেকে শুধু তথ্য নির্ভর সাংবাদিকতায় যাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। কারণ ৯০ এর গণঅভ্যুত্থানের পর দেশে গণতান্ত্রিক চর্চা হওয়ার কথা ছিল। এখানে মগণমাধ্যম দিয়ে রাজনৈতিক দর্শন প্রচারের বিষয় ছিল না। মানুষের অধিকার সচেতন করার বিষয় ছিলো না। ছিল সমাজের নানা অসঙ্গতি অনিয়ম সামনে আনা জরুরি ছিল। ১৯৯০ থেকে ২০০০ পর্যন্ত সাংবাদিকরা সেই চর্চাতেই ছিলেন। দুঃখ জনক হচ্ছে এর পর সাংবাদিকতার ধরণ বদলে গেলো। সর্বাধিক প্রচারিত সংবাদপত্রগুলোর মালিকানা চলে গেলো শিল্প গ্রুপের কাছে। যারা পত্রিকা ব্যবহার করলেন যার যার গ্রুপের স্বার্থে। সত্য প্রচারের দর্শন প্রবণ সাংবাদিকরা ততদিনে ক্লান্ত হয়েছেন। কেউ মারা গেছেন। তাঁরা যাদের পেশায় এনেছিলেন তাদের কেউ কেউ গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসাতে শুরু করলেন। যিনি দর্শনে থাকতে চাইলেন তিনি কোনঠাসা হয়ে গেলেন। আমাদের সাংবাদিকতার পরম্পরা নষ্ট হলো। লেখার এপর্বে পাঠক চলুন একটু পেছনে যাই। সেই ১২/ ১৩শ শতকে আজকের ইউরোপের কোন বন্দরে জাহাজ ভিড়তো। তখন তাদের কাছে একদল মানুষ আসতেন গল্প শুনতে। সেই গল্প তাঁরা শুনে অন্যকে বলতেন। এভাবে পৃথিবীর এক প্রান্তের জরুরি তথ্য ছড়িয়ে পড়তো অন্য প্রান্তে। মানুষ মূলত এই গল্প থেকে সভ্যতা বিকাশের তথ্যটি ছেকে নিতেন। তারা বুঝতেন কোন গল্পটি তাঁর লাগবে, কোনটি লাগবে না। অবশ্য আমাদের সাংবাদিকতার ইতিহাসে সেরকম কোন কথক সাংবাদিকের খোঁজ পাওয়া যায় না। এখানে ১৭৮০ সালে জেমস অগাস্টাস হিকির বেঙ্গল গেজেট প্রকাশ হয়। এর পর ইউরোপের সাংবাদিকতার সঙ্গে আমাদের সাংবাদিকতার মিল খোঁজার সুযোগ সৃষ্টি হয়। ১৫৫৬ সালে ভেনিসের প্রথম মুদ্রিত পত্রিকা নিটিজি স্কিট থেকে শুরু করে ১৬২২ এর ইংল্যান্ডের কারেন্ট অব জেনারেল নিউজ পর্যন্ত প্রতিটি পত্রিকার উদ্দেশ্য ছিল মানুষের অধিকার সচেতনতা সৃষ্টি। হিকির গেজেটের উদ্দেশ্যও ছিল মানুষের অধিকার সচেতনতা সৃষ্টি। সেই অধিকার সচেতনতা সৃষ্টির পরম্পরা আমরা দেখেছিলাম স্বদেশী আন্দোলন থেকে বাংলা ভাষার আন্দোলন পর্যন্ত। অনেকে বলবেন, গ সেসময়কার উত্তাল রাজনীতির পক্ষ নিয়েছিল সংবাদপত্র। আমি বলবো ওই সময় সাংবাদিকরা ঠিকঠাক সাংবাদিকতা করেছিলেন। স্বদেশী আন্দোলনের সময় নানা বাধার মুখেও সাংবাদিকতা চলেছে তাঁর নিজস্ব গতিতে। যেটা কাজে লেগেছে। অর্থাৎ বৃটিশ উৎখাত হয়েছে। এরপর আরো যেসব ছোটখাটো বদল দরকার হয়েছে সমাজে, তখনো সাংবাদিকতা সত্য তথা মানুষের পক্ষে ছিল। অন্তত ইতিহাস তাই বলছে। এই ধারাবাহিকতায় সাংবাদিকতা এসে পড়ে ভাষা আন্দোলনের কাছে। এখানে ভাষা আন্দোলনের কাছে গেলো সাংবাদিকতা না এই আন্দোলন সাংবাদিকতার জন্য সৃষ্টি হলো, এনিয়ে গবেষণা হতে পারে। এই সন্দেহ মূলত তুলেছিলেন বংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করতে যাদের আপত্তি ছিল তারা। তারা বলতেন বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে পত্রিকা অফিসে। এই বিরুদ্ধবাদিদের সংখ্যাটা যে খুব কম তা কিন্তু বলা যাবে না। ইতিহাস গবেষণায় ভাষা আন্দোলনের বিরোধিতাকারী যেসব বিখ্যাত ব্যক্তিদের নাম আসে শুনলে অনেকেই চমকে উঠবেন। এই লেখার উদ্দেশ্যে অবশ্য কাউকে চমক দেয়া নয়। আমি বরং বলি ‘ভাষা আন্দোলন সাংবাদিকদের সৃষ্টি’ এই দাবির যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে। কারণ রাষ্ট্রভাষার বাংলা করার রাজনৈতিক দাবি যখন আইনসভা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যাচ্ছিল সেই বার্তা বহন করছিলেন বেশিরভাগ সাংবাদিক। তাদের কেউ কেউ শুধু বার্তা বহন করে থেমে যাননি। রাষ্ট্রভাষার দাবি গণদাবিতে পরিনত করার কাজটিও সংগঠিত করেছিলেন। ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করার জন্যে তমদ্দুন মজলিস নামে যে সাংস্কৃতিক প্লাটফর্ম তৈরি হয়েছিল তাঁর মূল নেতৃত্বে ছিলেন সাংবাদিকরাই। প্রথম যে রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়েছিল সেখানেও ঘোষণা দিয়ে সাংবাদিকদের প্রতিনিধি রাখা হয়েছিল। ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসে আবার যখন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন হয়, তখনও নেতৃত্বের সামনের সারিতে যারা ছিলেন, তাঁদের বেশিরভাগই তখন সাংবাদিকতায় যুক্ত। ২১ শে ফেব্রæয়ারি রাষ্ট্রভাষার মিছিল গুলি এবং শহীদ হওয়ার খবর ঠিকঠাক ছাপতে না দেয়ায় দুএকটি পত্রিকা থেকে নেতৃত্বস্থানীয় সাংবাদিকরা চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। আমাদের সাংবাদিকতার পরম্পরার কথা বলছিলাম। তাই এত কথা এলো। কিন্ত যে কথাটি বলতে এত কিছুর অবতারণা, সেটা হচ্ছে আমাদের সার্বিক সাংবাদিকতা নিয়ে ইদানিং খুব প্রশ্ন উঠছে। গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান বাড়ছে। সংবাদ প্রকাশের মাধ্যম বাড়ছে। কিন্তু যেটা আতঙ্কের, সেটা হচ্ছে গণমাধ্যম মানুষের বিশ্বাস যোগ্যতা হারাচ্ছে। এটা কার দোষ, কার গুণ সেটা গবেষণার বিষয়। কিন্তু মোটা দাগে বলা যায় একই ঘটনার ভিন্ন ভিন্ন বিবরণে পাঠক বা দর্শক বিভ্রান্ত হচ্ছেন। কেন একই ঘটনার ভিন্ন বিবরণ? সহজ উত্তর, যে মাধ্যমের মালিক যেভাবে দেখতে চান, খবর সেভাবেই উৎপাদন হয়। অবশ্য সব খবরের ক্ষেত্রেই যে এরকম হচ্ছে এমনটি নয়। কখনো কখনো হচ্ছে। ওই কখনো কখনো’র খবরগুলো এক বালতি দুধে এক ফোটা লেবুর রস। আর মানুষের বিশ্বাস ভাঙলে তো জোড়াদেয়া কঠিন। পেশার স্বার্থেই এখন আমাদের সেই কঠিন কাজটি করতে হবে। আমার কিন্ত মনে হয় না এটা খুব কঠিন কাজ। কারণ আমাদের সাংবাদিকতার দীর্ঘ সমৃদ্ধ পরম্পরা রয়েছে। চাইলে সাংবাদিকরা ঠিকঠাক সাংবাদিকতা চর্চার দাবি তুলতেই পারেন। যেহেতু প্রশ্ন উঠেছে, সেই দাবি এখন তোলাই উচিত। কিন্তু তার আগে আজকের সাংবাদিককে প্রস্তুত হতে হবে। সেই প্রস্তুতি শুরু হওয়া দরকার চিন্তা থেকে। তাহলে দরকার চিন্তা বিষয়ক বিজ্ঞান ঠিকটাক দর্শনের। দর্শন তো সামনেই আছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং ভাষা আন্দোলন। এই দুই সমৃদ্ধতার কাছে গেলে তো দর্শন শুধু নয়, পরিস্কার দিক দর্শন পাওয়া যাবে। পলাশ আহসান, যুগ্ম প্রধান বার্তা সম্পাদক, একাত্তর টেলিভিশন। 8,667,526 total views, 2,850 views today |
|
|
|